বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৬ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

Ad
x

আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বৈদেশিক ঋণ

পান্না কুমার রায় রজত   |   রবিবার, ০৫ মে ২০২৪   |   প্রিন্ট   |   150 বার পঠিত

আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বৈদেশিক ঋণ

সরকারের মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদী উন্নয়ন পরিকল্পনার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য অত্যাবশ্যকীয় হচ্ছে উন্নয়ন খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা। অভ্যন্তরীণ উৎস হতে সম্পদ সরবরাহের সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বিনিয়োগ চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে বর্তমান আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বৈদেশিক সাহায্য বা ঋণ অপরিহার্য। আর একটি দেশের বিদেশি ঋণ হচ্ছে ওই দেশটি বিভিন্ন দেশ, বিদেশি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে যে ঋণ নেয়। বাংলাদেশ সাধারণত বিশ^ব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ঋণ নিয়ে থাকে।

বিশ^ব্যাংকের সাউথ এশিয়া ডেভেলপমেন্ট আপডেটে প্রকাশিত তথ্য মোতাবেক, উদীয়মান বাজার এবং উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশ ও অঞ্চলের দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সরকারি বিনিয়োগের তুলনায় বেসরকারি বিনিয়োগ খুবই কম। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাতের কারণে কৃষকরা কৃষি ছেড়ে অকৃষি খাতে যাচ্ছেন। তবে অকৃষি খাতে এত কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি। সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে কর্মসংস্থান সৃষ্টির আন্তঃনির্ভরতা আছে। এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং একটি ইতিবাচক ব্যবসায়িক পরিবেশ তৈরির বিষয়টিও রয়েছে।

আমরা যদি আশির দশকে ওপেকের সময়ের ঋণের সংকটের দিকে তাকাই তাহলে দেখব, লাতিন আমেরিকা বিপদে পড়েছিল স্বল্পমেয়াদি ঋণে, সেগুলো তাদের খুব সস্তায় দেওয়া হয়েছিল। ফলে তারা একসময় ঋণ সংকটে পড়েছিল। একই ঘটনা শ্রীলংকার ক্ষেত্রেও ঘটেছে। শ্রীলংকার অনেক ঋণ স্বল্পমেয়াদি। রপ্তানি আয় না বাড়ায় তারা সংকটে পড়েছে। একই সময়ে অনেক আফ্রিকান দেশেও একই সমস্যা তৈরি হয়েছে। তবে এটা ঠিক যে, এ ধরনের ঋণ এখন বাড়ছে। যেহেতু আমাদের রপ্তানি আফ্রিকার অনেক দেশের চেয়ে ভালো, তাই এ জায়গায় আমাদের তেমন সংকট নেই।

অর্থনীতিবিদগণ বলেছেন, বাংলাদেশের যে সকল অবকাঠামোভিত্তিক প্রকল্প আছে তার বেশির ভাগই ব্যয় বেশি। এসব প্রকল্পের বেশির ভাগই বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বৈদেশিক ঋণের মাধ্যমে। ফলে প্রকল্পের ব্যয়ে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা ঋণ পরিশোধ কিভাবে করব? আমাদের রপ্তানি আয় তেমন একটা উল্লেখযোগ্য নয়। যেখানে ভিয়েতনামের রপ্তানি আয় ৩০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি সেখানে ৪৫ বিলিয়ন রপ্তানি আয় দিয়ে আমরা কিভাবে ৩০০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয়ের দেশকে টপকে যাব। কারণ বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধেরও বাধ্যবাধকতা বাড়ছে যা সরকারকে অপর্যাপ্ত রাজস্ব আদায়ের মধ্যে ঋণ পরিশোধের জন্য ক্রমাগত নতুন ঋণ নিতে বাধ্য করছে।

জাতিসংঘের গ্লোবাল ক্রাইসিস রেসপন্স গ্রুপ বলছে, উন্নয়নশীল দেশগুলো উন্নত দেশের তুলনায় অনেক দ্রুত ও বিদেশি ঋণ নিয়েছে। অনেক উন্নয়নশীল দেশেই এ কারণে তা উদ্বেগের কারণ হয়েছে। ঋণের চাপে অনেকে আছে, অনেকে খেলাপি হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো সরকারি ঋণ ২০১০ সালে জিডিপির তুলনায় ৩৫ শতাংশ ছিল, ২০২১ সালে তা বেঁড়ে দাঁড়িয়েছে ৬০ শতাংশ। এসব বিদেশি ঋণের মাঝে ব্যক্তি খাতের ঋণও একইভাবে বেঁড়েছে। একই সময়ে ব্যক্তি খাতে ঋণ ৪৭ থেকে বেড়ে ৬২ শতাংশ হয়েছে।
গবেষণা সংস্থা সানেম কর্তৃক প্রকাশিত তথ্য মোতাবেক, দেশের প্রবৃদ্ধি কয়েক বছর ধরে ওঠানামার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে বিনিয়োগ আশানুরূপ নয়। বিনিয়োগ যেমন কম, দেশের প্রবৃদ্ধিও বাড়ছে কর্মসংস্থান ছাড়াই। প্রশ্ন হচ্ছে কর্মসংস্থান ছাড়া প্রবৃদ্ধি কিভাবে বাড়ে? হ্যাঁ, বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের উচ্চতর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে সরকারি বিনিয়োগের ভূমিকাই বেশি ছিল। প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকা চাকরির বাজারে আসা শ্রমশক্তির জন্য নতুন টেকসই কর্মসংস্থানে বেসরকারিখাত বেশি ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ হচ্ছে না। ফলে সবাই যেখানে শোভন চাকরির কথা বলছে, তেমন চাকরির সুযোগ বৃদ্ধি তো দূরের কথা, চাকরির নিশ্চয়তা দেওয়াই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশের রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত বিশে^র মধ্যে অন্যতম সর্বনিম্ন। এর সঙ্গে ঋণ বহনের সক্ষমতা ও ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা নিয়ে তাহলে কি আমরা উদ্বিগ্ন? কারণ দিন শেষে অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ গুরুত্বপূর্ণ যা অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি উভয় ঋণ পরিশোধের জন্য বিবেচনা করতে হবে। আমরা দেখতে পাই অন্যান্য দেশে জনগণের প্রাথমিক সঞ্চয়ের মাধ্যমে পুঁজি গড়ে উঠছে, কিন্তু বাংলাদেশে এটা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। দেশি-বিদেশি ঋণ সরকারের দায় বৃদ্ধি করছে। কোভিড-১৯, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতার কারণে ঋণ বেড়েছে বলে অনেকে দাবি করলেও প্রকৃত কারণ ভিন্ন বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদগণ। ২০১৮-২০১৯ সালে সরকারের আদায় হওয়া রাজস্বের ২৬ শতাংশ ঋণ পরিশোধে ব্যয় হতো। অথচ এই হার এখন ৩৪ শতাংশে উঠেছে, যেখানে অভ্যন্তরীণ ঋণ পরিশোধে যাচ্ছে ২৮ শতাংশ আর বিদেশি ঋণে যাচ্ছে সাড়ে ৫ শতাংশ। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, অর্থবছরের ৯ মাসে জুলাই-মার্চ ২০২৪ পর্যন্ত বাংলাদেশ শুধু সুদ বাবদ উন্নয়ন সহযোগীদের পরিশোধ করেছে ১০৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার। বাজারভিত্তিক ঋণের ওপর নির্ভরতার কারণে বেঁড়েছে সুদ পরিশোধের ব্যয়। আবার সুদ পরিশোধ বেড়ে যাওয়ার প্রভাবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ৯ মাস (জুলাই-মার্চ) বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ বেড়ে হয়েছে ২৫৭ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ১৭৪ কোটি ডলার।

তাহলে বিদেশি ঋণ নিয়ে কি উদ্বেগের কারণ আছে? উত্তরটা আপেক্ষিক। বিশ^ব্যাংক, আইএমএফ, ক্রেডিট রেটিং সংস্থা মুডি বা স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওরসের হিসেবে বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং কমেছে। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ জিডিপির ২৩ দশমিক ৪ থেকে ২৩ দশমিক ৮ শতাংশে আটকে আছে এক দশকের বেশি সময় ধরে। তাই খুব দ্রুত অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ বাড়াতে হবে। এছাড়া কোন বিকল্প নেই।

সূত্র মোতাবেক ২০২৩ সালের জুনে বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি বিদেশি ঋণ ছিল ৯৮ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার, যা একই বছরের সেপ্টেম্বরে ১০০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। বর্তমানে বিদেশি ঋণ-জিডিপি অনুপাত ২১ দশমিক ৬ শতাংশ তুলনামূলকভাবে বেশি নয়। তবে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা অর্জন করা অত্যন্ত জরুরি। আমাদের রেয়াতি ঋণের অনুপাত কমছে, অন্যদিকে রেয়াতি ও বাজারভিত্তিক ঋণের অংশ বাড়ছে। ঋণের শর্তাবলী ও আরও কঠোর হচ্ছে। বিশেষ করে জিডিপি রাজস্ব আয়, রপ্তানি, রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সঙ্গে তুলনা করলে বৈদেশিক ঋণ ও ঋণ পরিশোধের দায়বদ্ধতা আমাদের কিছুটা উদ্বিগ্ন করছে।

বিভিন্ন সময়েই দেশের ঋণ জিডিপির অনুপাত তুলে ধরে বলা হয় যে, বাংলাদেশে এখনো আরো অনেক বেশি বিদেশি ঋণ নেয়ার সুযোগ রয়েছে। অর্থনীতিবিদগণ মনে করেন, বাংলাদেশের মতো দেশে বিদেশি ঋণ জিডিপির অনুপাত হিসাব করাই অর্থহীন কারণ বাংলাদেশের কর-জিডিপির অনুপাত মাত্র ৮ শতাংশ। বৈদেশিক ঋণে বাড়তি ঝুঁকিসমূহের একটি হচ্ছে মুদ্রার দরপতন। যেমন ২০১৫ সালে ১০০ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেওয়া হল যখন এই ঋণ নেওয়া হয়েছিল তখন এক ডলারের বিপরীতে টাকার দাম ছিল ৮০। অর্থাৎ দেশীয় টাকায় বাংলাদেশ সরকার ৮০ হাজার কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে। কিন্তু ঋণ নেওয়ার কয়েক বছর পরই বাংলাদেশ ব্যালেন্স অব পেমেন্টস ক্রাইসিসে পড়ল। বাজারে পর্যাপ্ত পরিমাণ মুদ্রার জোগান না থাকায় কিছু দিনের মধ্যে এক ডলার সমান ১২০ টাকা হয়ে গেল। তাহলে বাংলাদেশ সরকারের ঋণ ও সুদের বোঝা শতকরা ৫০ ভাগ বেড়ে গেল। এমন প্রেক্ষাপটে সরকার কর্তৃক ঋণের ও সুদের দায় পূরণ অনেক বেশি হয়ে যায়। এজন্যই বৈদেশিক ঋণের ক্ষেত্রে ডলার রেট, ব্যালেন্স অব পেমেন্টস, রিজার্ভ, রপ্তানি, রেমিট্যান্স ইত্যাদির ওপর কড়া নজর রাখতে হয়।

আমাদের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা রয়েছে। তবে জনগণের করের টাকায় পরিশোধিতব্য এ সকল ঋণ ব্যবহার করে অবশ্যই সর্বোচ্চ উপযোগিতা যেন আমরা অর্জন করতে পারি সেটি নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক

Facebook Comments Box
top-1
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ২:১৯ অপরাহ্ণ | রবিবার, ০৫ মে ২০২৪

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
30  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
প্রকাশক : সায়মুন নাহার জিদনী
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।